রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৪ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি:
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছিল দুর্নীতিবাজরা। এরই মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গণমাধ্যমে। সবশেষ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের হাজার কোটি টাকার সম্পদের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা। প্রশাসন ও পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে চলছে আলোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলধারার অনেক গণমাধ্যমকে ‘ম্যানেজ’ করতে পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্নীতি করে গড়ে তোলা সম্পদের তালিকা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় অনেকেই দেশে গড়ে তোলা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা বিদেশে পাচারের সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সরাসরি বা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপগুলোতেও চলছে এই আলোচনা। সবারই একই প্রশ্ন এর পরে কে? কার বিপুল সম্পত্তির খবর প্রকাশিত হবে গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে? অনেক কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের কাছে খোঁজ-খবর নেওয়ারও চেষ্টা করছেন।
প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকতারা দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ায় সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেক সৎ কর্মকর্তা। তারা মনে করছেন, টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে অনেক কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদে দায়িত্ব পালন করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদের ধারণা ছিল, বর্তমানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সরকারে থাকা অবস্থায় কখনোই তাদের বিপাকে পড়তে হবে না। কিন্তু বেনজীর, আছাদুজ্জামান মিয়া বা এনবিআর কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান, ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি ফারজানা ফারভিন, রাজবাড়ীর সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ মাহবুবুর রহমান ও তার সহধর্মিনী সরকারী নজরুল কলেজ ত্রিশালের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বপ্নের আলাদিনের চেরাগ, ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার সাবেক ওসি মোঃ মাহমুদুল ইসলাম বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশের পর অন্যান্য দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, সৎভাবে চাকরি করার কারণে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরেও ভালো কোনও জায়গায় পোস্টিং পাননি। কারণ ভালো জায়গায় পোস্টিং পেতে হলে ঊর্ধ্বতনদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। এত টাকা তার নাই এবং টাকা দিয়ে পোস্টিং পাওয়ার ইচ্ছেও তার ছিল না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকের তুলনায় বর্তমানে দেশের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের নিয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলছে। গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে বিষয়গুলো ভাইরাল হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও দুর্নীতিবাজদের পক্ষ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলছেন, মানুষের মধ্যে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, এটা অবশ্যই আশার কথা। যদিও আপাতত এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যদি স্থায়ী রূপ লাভ করে এবং পক্ষপাতহীন হয় তাহলে এটা কাজ করবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হলেই দুর্নীতি কমিয়ে আনা যাবে।
সাবেক এই আমলা বলেন, প্রশাসন বা পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কেবল অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধানে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে মামলা হবে। মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। বিচারে রাষ্ট্রপক্ষকে দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হবে। তারপর রায়ে যদি শাস্তি হয়, যদি যথাযথ বিচার হয়, তবেই ভালো প্রভাব পড়বে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই নিজের নামে সম্পদ না কিনে স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের নামে কেনেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অসংখ্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরাও দুদকের মামলার আসামি হয়েছেন। এ কারণে বর্তমানে অনেক দুর্নীতিবাজ স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের নামে স্থাবর সম্পত্তি না কিনে বিদেশে পাচার করছেন। ছেলে-মেয়েদের কাউকে বিদেশে পড়াশোনা করতে পাঠানোর নামে সেখানেই দুর্নীতির অর্থ পাঠাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক সরব হওয়ার কারণে অনেকেই স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করছেন। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে যারা ভূ-সম্পত্তি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন তারা সেসব ভূ-সম্পত্তি বা ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টা করছেন। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে আত্মীয়-স্বজনদের নামে বিনিয়োগের চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই এবং ইউরোপের পর্তুগাল ও রোমানিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এসব দেশে বিনিয়োগ করলে সহজেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় তার বসের একটি ফ্ল্যাট ছিল। অনেক অর্থ ব্যয় করে তিনি ফ্ল্যাটটি সাজিয়েছিলেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে তিনি তড়িঘড়ি করে শখের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিয়েছেন। ময়মনসিংহের কয়েকটি থানার সাবেক ও বর্তমান ওসিদের ঘুসকাণ্ডে তাদের স্ত্রীরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন। গড়েছেন আলিশান বাড়ি। কেউ কেউ বিদেশে সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। অভিযোগ আছে, ময়মনসিংহ ডিবির সাবেক একজন ওসি রাজধানীতে ৩ ফ্ল্যাট,উওরায় ২৩ শতাংশ ,গুলশানে দুটি ফ্লাট,ময়মনসিংহ নগরীর বাইপাস এলাকায় ৭৮ শতাংশ, নটরডেম কলেজ সংলগ্ন ৪৫ শতাংশ, বাইপাস মহাসড়ক সংলগ্ন জামালপুর রোড ৩৪ শতাংশ, শম্ভগঞ্জ এলাকায় ১৩৫ শতাংশ, নেত্রকোনা রোড ২৩ শতাংশ জমি বিভিন্ন সময়ে ক্রয় করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫৫ কোটি টাকা।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার সাবেক ওসি মোঃ মাহমুদুল ইসলাম ইতিমধ্যে পরিবার নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। অনেকেই বলছেন তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে এক সাবেক এসপির যোগসাজস রয়েছ। জামালপুর,রাজধানীসহ বিভিন্নস্থানে অনুসন্ধান চলছে। অপরদিকে এক পাবনা জেলার দশ বিড়ি কারখানা কীভাবে প্রতিবছর সরকারের সাতশ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তার বিবরণও জানছেন পাঠকরা। খাগড়াছড়িতে সাবেক মন্ত্রীর অঘোষিত ব্যবসায়িক পার্টনার হয়েই বাদাম বিক্রেতা অমল শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। নেতাদের লুটপাটের বিবরণে উঠে এসেছে সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও তার ভাই সমরের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের কাহিনি। নিউজের পর কালিয়াকৈরে কর্মরত সাব-রেজিস্টার দুর্নীতিবাজ মো. নুরুল আমিন তালুকদারের ১২ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে দুদক। শেরপুরের শ্রীবর্দী রেঞ্জের বনায়নেরই ১০ কোটি টাকার গরমিল,গাজীপুরের মৌছাক পুলিশ ফাড়ীঁর ইনচার্জ সাইফুল আলমের শত কোটি টাকার মালিক এমন তথ্যও মিলেছে সংবাদ সূত্রে। অভিযোগ উঠলেই সক্রিয় হওয়া উচিত দুদকের বলে করেন সচেতন নাগরিকগন।
উপরদিকে ইতি মধ্যে আলোচনায় রাজবাড়ীর সাবেক সিভিল সার্জন ও তার সহধর্মিনী ময়মনসিংহের সরকারী নজরুল কলেজ ত্রিশালের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বপ্নের আলাদিনের চেরাগ। ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্র প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে ৩৪ শতাংশ জমির মধ্যে ছয়তলা বিশিষ্ট আলীশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। দিগারকান্দা এলাকায় জমি ক্রয় করেছেন আরও ১০ কোটি টাকার জমি। সেখানে বাড়ি নির্মাণে খরচ করেছেন প্রায় ১০ কোটি টাকা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী কক্সবাজারে পোস্টিং নিতেই দুই কোটি টাকা ঘুস দিচ্ছেন।
কোটি কোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়া সাতক্ষীরার প্রাননাথ দাশ অবশেষে ভারতীয় পুলিশ এর কাছে আটক হয়েছে। এপার থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে নির্বিঘ্নে কিভাবে পালিয়ে গেল প্রশ্ন উঠছে সেসব নিয়ে। এ রকম শত শত লুটপাটের কাহিনি বেরিয়ে এসেছে এবং প্রতিদিনই বের হচ্ছে। এদিকে ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ন্যাশানাল সার্ভিস কর্মসুচী প্রকল্পের ২৯২ কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে নামে। ইতি মধ্যেই সকলকে পত্র দিয়েছেন দুদক ময়মনসিংহ জেলা শাখা।